একটু ভেবে দেখব কি?
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১১:০৪:১১ রাত
" পৃথিবীটা বড় রঙিন
ভাবত এ কথা খোকন
তাঁকে ঘিরে কত হাসি আনন্দ
থাকত ঘিরে যখন।
ছোট্ট খোকন বাবা আর মা
দুপুর রাত্রি সকাল সন্ধ্যা
সুখের সাতকাহন
ভাবত এ কথা খোকন।
বাবা বেরোতেন সকাল বেলায়
অফিস অভিমুখে
মার সারাদিন গুন গুন গাওয়া
ঘরের কাজ আর শুধু পথ চাওয়া
ফিরবেন বাবা সন্ধ্যেবেলায়
কখন হাসিমুখে।
দুজনের চোখে কত ভালোবাসা
দেখত সবই খোকন
পৃথিবীটা বড় রঙিন
ভাবত এ কথা তখন।
ছুটির দিনে নিত পার্কেতে
কিংবা চিড়িয়াখানায়
সারাদিন শুধু ছুট আর ছুট
ক্যাডবেরি আইস্ক্রীম ডাল মুঠ
খেলা আর খেলা মার লিপস্টিক
বাবার সাদা জামায়।
বাবার চওড়া কাঁধেতে আরামে ঘুমোতো সে যখন
পৃথিবীটা বড় রঙিন
ভাবত এ কথা তখন।
খোকন এখন হোষ্টেলে থাকে
রঙিন পৃথিবী কালো
বাবা করেছেন বিয়ে আবার
মা করেছেন লীভ টুগেদার
খোকন ছাড়া আর মোটামুটি সবাই রয়েছে ভালো
দুটো পার যদি এক হতে না চায়
সেতুর কি প্রয়োজন?
বিষের প্যাকেট খোকনের হাতে
ভাবছে খোকন যাবে কোন খাতে
অনাহুত হয়ে বেঁচে থাকা নাকি মৃত্যুর আয়োজন।।
বিষ হাতে নিয়ে খোকন
ভাবছে এ কথা এখন।"-নচিকেতা
অলস সময় এখন অফুরন্ত। হাতে তেমন কাজ নেই। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সময় কাটানো, ইবাদতে মশগুল হওয়া আর টুকটাক লিখালিখিতে প্যারোলের আট দিনের দুট দিন প্রায় শেষ হই হই। নচিকেতার এই গানটি শুনছিলাম। গানের কলিগুলোতে এমন কিছু অনুভূতি মিশে ছিল, যা আমাকে যারপরনাই ব্যথিত করে তুলল।
পারিবারিক সম্পর্কগুলোর ভিতরে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি একটি পরিবারের ভিতরে অন্যতম প্রধান এবং বাবা-মায়ের পরেই একটি সংসারকে টিকিয়ে রাখতে এই সম্পর্ক বেশ ভূমিকা রাখে। অন্যভাবে বলতে গেলে বাবা-মা-ই একসময় স্বামী-স্ত্রী’র ভূমিকা নেয়। আর এই দু’টি রূপে বাবা/মা এবং স্বামী-স্ত্রী – তাদের কর্মকান্ডে সন্তানেরা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।
সন্তানের মানসিক বিকাশ উন্নত কিংবা বাঁধাগ্রস্ত হয় তাদের কর্মকান্ডের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকার দ্বারা।
আমার ওয়াইফ একটি কিন্ডারগার্টেনে জব করে। তার কাছ থেকেই শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কথা শুনে থাকি। এক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নিজেদের ভিতরে ছোট খাট ব্যাপার নিয়ে কলহে লিপ্ত থাকে। এদের একমাত্র সন্তানের সামনেই অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে। পুরুষ ভদ্রলোকটি (তাকে ভদ্রলোক বলা যায় কি?) প্রায় সময় তার অর্ধাঙ্গীনির শরীরে হাত তোলার মত জঘন্য কাজটিও করে থাকেন। আর এই ঘটনাটি তাদের সন্তানের শিশুমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে ভিতরে ভিতরে ম্রিয়মান এবং বিষন্নতায় ভুগতে শুরু করে। নিজের মনোজগতে সে একটি আলাদা ভূবন গরে তোলে-যেখানে অহর্নিশি ভয়-আতংক তাকে তাড়া করে ফিরে। ঘুমের ঘোরে সে ভয়ে আতকে উঠে। অন্যান্য ছেলেমেয়েদের যে স্বাভাবিক চাঞ্চল্য বিরাজ করে, তাঁর ভিতর থেকে সেগুলো ধিরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকে। প্রায়ই তাকে দেখা যায়, খেলার মাঠের এক কোনে একা একা বসে থাকতে। আর ক্লাশের অন্য কাছের বন্ধুদের সাথে সে নিজের বাবা-মায়ের এই অপ্রীতিকর ব্যবহারগুলো শেয়ার করে। অন্যদের বাবা-মা ও কি একই ব্যবহার করে কিনা সে জানতে চায়। এরকম দুজন ছাত্রের কথোপকথন একদিন আমার ওয়াফ শুনতে পায়। এই বয়সে ঐ শিশুটির মনের ভিতরের এই ধরণের প্রশ্নের উদ্ভব জানতে পেরে সেও খুব দুঃখ পায়।
আর এক শিশু একদিন অন্য একজনের সাথে ঝগড়ার সময়ে খুবই অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে, যা সচরাচর বাহিরে তার শুনতে পাবার কথা নয়। তখন ক্লাশের টিচার শুনতে পেয়ে তাকে বলেন-
‘ এগুলো বলতে হয় না, এগুলো বলা ভালো না। মানুষ খারাপ বলবে।
- কেন টিচার? আমার আব্বু তো আম্মুকে এগুলোই বলে। আব্বু কি খারাপ?
টিচার ভেবে পান না এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন। একজন স্বামী প্রচন্ড ক্রোধের সময়ে তার অর্ধাঙ্গিনীকে যদি এধরণের স্ল্যাং ব্যবহার করেন, তবে এইগুলোতে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার কোমলমতি সন্তান। সন্তানেরা নিজ নিজ বাবাকে বেশী অনুকরণ করে। এই অনুকরণের ক্ষেত্রে সে ভালো-মন্দ যাচাই করে না। ঐ বয়সে বাবাই তাঁর একমাত্র আদর্শ থাকে এবং বাবাকে অন্ধ অনুকরণ করার ফলে নেতিবাচক অনুভুতিগুলোও তাঁর ভিতরে আসন গাড়ে।
আর একটি দিক হল, সংসারে চাহিদার কোন শেষ নেই। এক পরিবারে এক শিশু দেখে তাঁর মা তাঁর বাবার উপর বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা নিয়ে প্রেসার ক্রিয়েট করছে। অমুকের স্বামী এইটা করেছে... তমুকের স্বামী ঐ জিনিস এনে দিয়েছে ইত্যকার আশেপাশের প্রতিবেশিদের উদাহরণ টেনে স্বামী বেচরাকে পাগল করে দেয়। এগুলো দেখে সন্তানের মনেও তাঁর আশেপাশের বন্ধুদের জীবনযাপন পদ্ধতি চোখে লাগে। আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থার গলদের কারনে পরিবারগুলোর ভিতরে বৈষম্য এতটা প্রকট এবং অসংগতি গুলো এমন নির্লজ্জভাবে ফুটে উঠে যে, পরিবারের আদর্শ ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাহিদার বিপরীতে না পাওয়ার ক্ষোভ ও ব্যথা অবলোকন করে করে আমাদের সন্তানেরা তাদের মত করে চাহিদার লিস্ট উত্তরোত্তর বাড়িয়েই চলে। তারা নিজের অভিভাবকের কাছে এভাবে বলে-
‘ ইফতির বাবা ওকে সাইকেল কিনে দিয়েছে, আমাকে কেন দিচ্ছ না?
কিংবা
‘আজ রাসেলের কাছে গ্যালাক্সি ট্যাব দেখেছি। আমাকে কবে দিচ্ছ?’
এই ভাবে আমরা অভিভাবকেরাই নিজেদের অগোচরে আমাদের সন্তানকে ক্রমশ জটিল এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এই ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তার সময় কি এখনো আসেনি?
নচিকেতার গানটি দিয়েই লিখাটি শুরু করেছিলাম। এখানে এক খোকনের কথা বলা হয়েছে। যার সুন্দর একটি পৃথিবী ছিল নিজের বাবা-মায়ের ভিতরের ভালোবাসাময় জগতের ভিতরের স্বর্গসম ভালোলাগার নিগড়ে। কিন্তু ধিরে ধীরে খোকন বড় হয়... বাবা-মা’র ভিতরেও ভালোবাসাগুলো কিভাবে যেন হ্রাস পেতে থাকে। ‘পরকিয়া’ নামের এক সামাজিক ব্যাধি খোকনের নিজের স্বাভাবিক জগত থেকে ওর সেই ভালোলাগাগুলোকে কেড়ে নেয়। নিজের বাবা-মায়ের ভিতরে এক অদৃশ্য সেতু হিসেবে কাজ করা খোকন নিজেকে আর সেতু হিসেবে ভাবতে না পেরে অস্বাভাবিক জীবনকে সহ্য করতে না পেরে হাতে বিষের প্যাকেট তুলে নেয়। এভাবে অনাহুতের মত বেঁচে থাকবে নাকি একেবারে চলে যাবে সেই ভাবনায় ব্যস্ত আমাদের খোকনেরা।
এখন আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা আমাদের খোকনের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছি?
বিষয়: বিবিধ
১২১৭ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে অনেক ভালো লাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম!
হ্যা আপু, এখন সময় এসেছে আমাদেরকে আসল পথটি বেছে নেবার।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
হাদীসে রাসুলﷺ: যে আমাকে তার মুখ ও যৌনাঙ্গের নিশ্চয়তা দিবে আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি
শৈশব থেকেই গালির ব্যবহার/উচ্চারণ না করার কঠোর প্রশিক্ষণই এ রোগের অন্যতম মহৌষধ!
আমি আব্বার হাতে সারাজীবনে মাত্র একবার মার খেয়েছি-
তখনো আমার স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি-
একজনকে "কুকুর" বলে গালি দেবার জন্য-
সেই প্রথম ও শেষ
আর কোন মা নিজেই যদি চাহিদার লিষ্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তবে সন্তানকে সচ্চরিত্র শিখাবেন কেমন করে!!
ধন্যবাদ ভাইয়া লিখার সাথে প্রাসঙ্গিক হাদীসটি উল্লেখ করার জন্য।
আপনার আব্বা আপনার জন্য যে বিষয়ে কঠোর হয়েছিলেন, আপনি তাঁর মান রাখতে পেরেছেন, এজন্য জাজাকাল্লাহ।
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ সেজন্যও।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার এবং পরিবারের বাকীদের সাথে নিয়ে এই ঈদ ইনশাআল্লাহ আনন্দে কাটুক, সেই প্রত্যাশা করছি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মত যারা এখন সংসার জীবনে পা রাখেন নাই (আমি জানি না, অনুমান করলাম আর কি),তারা এই ব্যাপারে একেবারে শুরু থেকেই যত্নবান হতে পারেন।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
চমৎকার পোষ্ট।
হ্যাঁ, আজকাল এই বিষাক্ত 'সম্পর্কটি' আমাদের সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনকে একেবারে ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দিচ্ছে।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সহমত আপনার সাথে।
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ঈদের শুভেচ্ছা রইলো।
নরম কাদা মাটি তুল্য শিশুদের পবিত্র মানসপটে পরিবারের একে দেয়া দাগ সহজে মুছে যায় না,তা ভাল বা খারাপ যে কোন দাগ ই হোক না কেন! বিশেষ করে মা-বাবার পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক প্রভাব ফেলে শিশু মনে।বিষয়টা মাথায় রেখেই মা-বাবা কে সামলে চলতে হবে।
অসাধারণ সুন্দর উপস্হাপনার জন্যে শুভেচ্ছা ও জাযাকাল্লাহ আপনাকে......।
সহমত আপনার সাথে।
শুভেচ্ছা আপনার জন্যও।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার দোয়া আল্লাহপাক কবুল করুন-আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সাথে থেকে অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনুভুতি রেখে গেলেন, জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন